প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশ একটি বন্যাপ্রবণ অঞ্চল। গরম শেষ হতে না হতেই, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে প্রায় প্রতি বছরেই বন্যায় ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। বর্তমানে সিলেট বিভাগের কয়েকটি জেলার মানুষ বন্যার পানিতে বন্দী। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোতে বাড়ছে পানি এবং এর পাশাপাশি বৃষ্টিপাতও হচ্ছে। তাই বড়সড় একটা বন্যার কবলে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে দেশ।
বন্যা যেমন সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি ভাসিয়ে নিয়ে আসে নানা রোগজীবাণু। উপদ্রুত এলাকায় তাই বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই দেখা যায়। কারণ, এ সময় পয়োঃনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র পানির সঙ্গে মিশে দূষণ সৃষ্টি করে। এই দূষিত পানিতে নানা ধরনের জীবাণু চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পানিবাহিত বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার ঘটে। যার ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে যান শিশু, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধরা। কার্যকারণ হিসাবে আলাদা করে দেখলে, যে কয়েকটি কারণে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকে তার মধ্যে রয়েছে:
১. পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ: বন্যার দূষিত পানি খাবার পানির উৎসগুলোকে দূষিত ও সংক্রমিত করে। এতে স্যানিটারি টয়লেটগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দূষিত পানিতে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী কলেরা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার গ্রহণ, অপরিষ্কার হাত বা নোংরা প্লেট, জীবাণুবাহক পোকামাকড় ও মশা-মাছির জন্য পানিবাহিত রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব বাড়ে।
২. অস্বাস্থ্যকর খাবার: বন্যার পানিতে বিভিন্ন ধরনের ময়লা, মানব ও প্রাণিজ বর্জ্য এবং খামার ও শিল্প এলাকার রাসায়নিকগুলো মিশে যায়। যা কৃষি জমিগুলোয় খাদ্যশস্যকে নষ্ট করে ফেলে। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হওয়ায় হিমায়িত সঞ্চিত খাদ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. মশা, প্রাণী ও সাপের উপদ্রব: দীর্ঘায়িত বৃষ্টিপাত এবং বন্যা আর্দ্র অঞ্চল এবং আবদ্ধ জলাশয় সৃষ্টি করে। যা মশার জন্য প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে কাজ করে। ফলে, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে। বন্যার পানিতে সাপ নিজেদের আবাসস্থল থেকে খোলাখুলি বাইরে আসতে বাধ্য হয়। সাপগুলো তখন শুকনো জায়গার সন্ধানে মানুষের কাছাকাছি চলে আসে, তাই বন্যার পরে সাপে কামড়ানোর ঘটনা বেড়ে যায়। তাছাড়া বন্যপ্রাণী, ইঁদুর ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ধরনের রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
৪. পানিতে ডুবে মৃত্যু: বন্যার সময়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। অসাবধানতার কারণে শিশুরাই এক্ষেত্রে বেশি ভুক্তভোগী হয়।
৫. আর্দ্র আবহাওয়ায় ফাঙ্গাসের সংক্রমণ: বন্যার আর্দ্র আবহাওয়ায় ফাঙ্গাসের বংশবিস্তার ঘটে। তাই, যারা অ্যালার্জি এবং হাঁপানিতে আক্রান্ত, তাদের শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগের মাত্রা বেড়ে যায়। এছাড়া ময়লা পানিতে নেমে, দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ত্বকের সংক্রমণ যেমন– দাউদ, খোস-পাঁচড়া, চুলকানিসহ নানা ধরনের চর্মরোগের বিস্তার ঘটতে পারে।
৬. দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি: নিরাপদ পানীয় জলের অভাব এবং স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবারের স্বল্পতা বানভাসি জনগণের বিশেষত দরিদ্র পরিবারের শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
এছাড়াও যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর এবং সম্পত্তির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মেরামতে সাধারণত বেশি মনোযোগী ও ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। যা ভুক্তভোগীদের মানসিক চাপ ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।