ঘাম মুছতে মুছতে রিকশাচালক মহিব উল্যাহর লাল গামছাখানা জবজবে! অন্যদিন সকাল-সন্ধ্যা রিকশা চালালেও গতকাল শনিবার বেলা ১১টা বাজতেই হাঁপিয়ে গেছেন তিনি। ক্লান্ত দেহ আর চলছে না। দুপুর না গড়াতেই অবসন্ন শরীরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের গ্যারেজে মহিব উল্যাহ জমা দিয়ে দিলেন রিকশা। গ্যারেজ থেকে বেরিয়েই বলছিলেন, ‘মনে হচ্ছে, সূর্য মাথার ওপর নেমে এসেছে। রিকশার প্যাডেল আর মারতে পারছি না। তাপে যেন শরীর পুড়ছে। এ রকম হলে জীবন বাঁচবে না।’
প্রখর তাপপ্রবাহ আর গরমে ঘরে-বাইরে মানুষ এমনই হাঁসফাঁস করছে। জনজীবন এক রকম বিপর্যস্ত। দুই জেলায় চলছে অতিতীব্র তাপপ্রবাহ; সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় চুয়াডাঙ্গাকে ছাড়িয়েছে যশোর, পারদ উঠেছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র গরমে চুয়াডাঙ্গা ও পাবনায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত তাপে গলে যাচ্ছে রাস্তার পিচ।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের সব স্কুল-কলেজ সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। ঈদের ছুটি শেষে রোববার খোলার কথা থাকলেও এখন তা খুলবে ২৮ এপ্রিল। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ক্লাসও। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবীদের কালো গাউন পরার আবশ্যকতা শিথিল করা হয়েছে। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার কারণে জরুরি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। হাসপাতালে হিট স্ট্রোকের রোগীও বাড়তে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এদিকে প্রচণ্ড গরমে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না কেউ। গতকাল ঢাকার রাস্তাঘাট ছিল অনেকটাই ফাঁকা। শপিংমল, কাঁচাবাজার, ফুটপাতে বেচাবিক্রি নেই; অনেক দোকানপাটও ছিল বন্ধ। যাদের ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা, তাদের ঘর থেকে না বেরিয়ে উপায় নেই। জীবিকার তাগিদে তীব্র রোদে কাজ করতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষকে।
এপ্রিলের প্রথম দিকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ শুরু হয়। ৭ ও ৮ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হয়। এতে তাপমাত্রা কিছুটা কমে। এরপর ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ১৫ এপ্রিল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র তাপপ্রবাহ বইতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তাপপ্রবাহের এলাকাও বেড়ে যায়। আর গতকাল দেশের একাধিক এলাকায় অতিতীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, আগামী দুই থেকে তিন দিন তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নেই। আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেসা বলেন, ২৫ এপ্রিলের দিকে গরমের তীব্রতা কমে এলেও মাসজুড়েই বিরাজ করবে তাপপ্রবাহ। তখন অতিতীব্র থেকে তীব্র, তীব্র থেকে মাঝারি এমন থাকবে। এ মাসে বড় পরিসরে বৃষ্টির সম্ভাবনাও নেই। বিচ্ছিন্নভাবে সিলেটের দু-এক জায়গায় হতে পারে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।
গেল বছর পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। ১৯৯৫ ও ২০০২ সালেও সমান তাপমাত্রা উঠেছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে; দেশে আবহাওয়ার রেকর্ড রাখা শুরুর পর এটাই সর্বোচ্চ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়া সহকারী মো. ফরমান আলী বলেন, ১৯৬৫ সালে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল রাজধানীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকালও রাজধানীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মানুষের নাভিশ্বাস
মাথার ওপর গনগনে সূর্য ও অসহ্য গরমে বাইরে একদণ্ড টিকে থাকাই মুশকিল। রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার বাসিন্দা হোসনে আরা বেগম বেলা ১১টায় বাজার করতে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্য, রোদ সরাসরি যেন মাথায় এসে লাগছে। গরমটা আজ টের পাচ্ছি। তাপটা অনেক বেশি।
গরমে স্থবির হয়ে পড়েছে শ্রমজীবীদের জীবনও। মিরপুরের পশ্চিম মনিপুরে রিকশা চালানো মো. শহীদকে দেখা গেল, একচিলতে ছায়া পেয়ে বিশ্রাম নিতে বসে পড়েছেন সেখানেই। গরমের কারণে তাঁর আয়ও কমেছে। মাঝবয়সী চালক আবুল কাশেম বলেন, ‘প্রচুর গরম। গরমের জন্য পরে বাইর হইছি। কষ্ট হয়। কী করুম, চালানি তো লাগবোই! গরমের কারণে খ্যাপ কমছে। আগে দিনে ছয়-সাতশ ট্যাকা থাকত, এহন তিন-চাইরশর বেশি থাহে না।’
এ গরমে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ট্রাফিক ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশরাও। শিশুমেলা এলাকায় দায়িত্বরতদের একজন বলেন, ‘অবস্থা খুবই ভয়াবহ। ড্রেসটা খুলে দেখাইলে বুঝতে পারতেন। গেঞ্জি পুরো ভিজে গেছে। আমাদের তো কাজে কোনো কম্প্রোমাইজের সুযোগ নেই।’
আগারগাঁওয়ের নানা হাসপাতালে সেবা নিতে আসা লোকজন এদিন খুঁজছেন দু’দণ্ড ছায়া। উন্নয়নকাজ চালাতে গিয়ে এই এলাকায় গাছ কমিয়ে ফেলার অভিযোগও করলেন কেউ কেউ।
রোমান চৌধুরী নামের এক চাকরিজীবী বলেন, ‘গরমে পাগল হওয়ার মতো অবস্থা। রাস্তার ধারে শরবত খাইলাম। তাও কুলানো যায় না।’
ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার বলেন, সারাদিন গরম লাগছে, ঘাম হচ্ছে না, শরীর জ্বলছে। এর কারণ হচ্ছে, দখিনা বাতাস নেই। সাগর থেকে উপকূল হয়ে যে বাতাস আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশের কথা, সেটা আসছে না। ফলে আর্দ্রতা নেই। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিরুদ্ধাচরণের ফলে এমন পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের গাছপালা নেই, নদী নেই। শুধু নদীই নয়; পুকুরের মতো যে জলজ পরিবেশ আছে, সেগুলোও আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। ফলে বাতাসে আর্দ্রতা তৈরি হচ্ছে না।
চু্য়াডাঙ্গায় দুই ও পাবনায় একজনের মৃত্যু
অত্যধিক গরমে অসুস্থ হয়ে চুয়াডাঙ্গায় দুই ও পাবনায় একজনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তারা হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন কিনা তাৎক্ষণিকভাবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। চুয়াডাঙ্গায় মারা যাওয়া দু’জনের মধ্যে জাকির হোসেন দামুড়হুদার ঠাকুরপুর গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে। তিনি ঠাকুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি। অন্যজন মর্জিনা খাতুন, তিনি দামুড়হুদা ইউনিয়ন পরিষদ পাড়ার আজিম উদ্দীনের স্ত্রী। শনিবার সকালে ধানক্ষেতে সেচ দিতে যান জাকির। এ সময় তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে, বিকেল ৩টার দিকে অত্যধিক গরমে নিজ বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন মর্জিনা খাতুন। পরে তাঁকে দামুড়হুদা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
পাবনা শহরের শালগাড়িয়া এলাকায় মারা গেছেন সুকুমার দাস। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি রূপকথা রোড এলাকার একটি দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। তীব্র গরমে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, হিট স্ট্রোকের রোগী ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নির্দেশিকা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে হাসপাতালগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া রোগী ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছুটির কারণে ২৮ এপ্রিল খুলবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গতকাল দুই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোর পক্ষ থেকে আলাদাভাবে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
তীব্র তাপদাহের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ক্লাস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
গরমে গাউন পরা থেকে রেহাই পেলেন আইনজীবীরা
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. গোলাম রব্বানী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশজুড়ে চলমান তাপপ্রবাহের কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের আলোচনাক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে মামলা শুনানিকালে আইনজীবীদের গাউন পরিধানের বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হলো। একই কারণে গত ৫ এপ্রিল অধস্তন আদালতেও কোট ও গাউন পরার বাধ্যবাধকতা শিথিল করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।
২০২১ সালে তালিকাভুক্ত এক আইনজীবীর মৃত্যুর পর পোশাকের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। গত ১১ মে হিট স্ট্রোকে ঢাকায় এক আইনজীবীর মৃত্যুর দু’দিন পর গরমে কালো কোট-গাউনের ‘যন্ত্রণা’ থেকে মুক্তি মেলে আইনজীবীদের।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ সাইফুল ইসলাম
কর্পোরেট অফিস : ৩৪৩ উত্তর নয়ানগর, কোকাকোলা রোড, বারিধারা ব্লক - জে, ভাটারা, ঢাকা ১২১২
মোবাইল : ০১৭৪১০০৩৫১১, ০১৭৪১০০৩৫১৭
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত